পণ্যবাহী যানের ভাড়া ঠিক করার কেউ নেই

 পণ্যবাহী যানের ভাড়া ঠিক করার কেউ নেই




মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। পাঁচ বছর আগে এই পথে পণ্যবাহী ট্রাকের ভাড়া ছিল তিন হাজার টাকা। এ সময়ের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে তিনবার। ফলে বেড়েছে ভাড়াও।


গত বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জ থেকে কারওয়ান বাজারে সবজি নিয়ে আসা আওয়াল বেপারী ভাড়া দিয়েছেন আট হাজার টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়ে প্রায় ১৪৬ টাকা।
বগুড়া থেকে কাঁচামাল নিয়ে কারওয়ান বাজারে এসেছেন রোকন মিয়া। বগুড়া-ঢাকার দূরত্ব প্রায় ১৫৬ কিলোমিটার। এই পথের জন্য তাঁকে ভাড়া দিতে হয়েছে ১৪ হাজার টাকা। প্রতি কিলোমিটারে তাঁর ভাড়া পড়েছে প্রায় ৯০ টাকা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) আনুষ্ঠানিকভাবে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে তা করা হয় না। ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ হয়ে পড়ছে লাগামহীন এবং অনেকটা ইচ্ছামাফিক।

আওয়াল বেপারী জানালেন, তিন মাস আগেও ঢাকা-মানিকগঞ্জ রুটে ট্রাকভাড়া ছিল পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। এখন ভাড়ার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ছয় দিন আগে তিনি সবজির ট্রাকের ভাড়া দিয়েছেন সাত হাজার টাকা। এখন (গত বৃহস্পতিবার) আট হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘ভাড়ার এই টাকা মাল বিক্রি করেই তুলতে হয়। যেদিন বেশি ভাড়ায় আসি, সেদিন মালের দাম কিছুটা বাড়িয়ে বিক্রি করতে হয়। ’ পণ্য পরিবহনসংশ্লিষ্ট যে সমিতিগুলো রয়েছে, তারাও পণ্য পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে না। অনেকটা চাহিদা-জোগানের ওপর ভিত্তি করে পণ্য পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ হয়ে আসছে। আবার বিভিন্ন ট্রাকস্ট্যান্ডে রয়েছে দালালচক্র। তাদের মাধ্যমে ট্রাক ভাড়া করতে গেলে আরো অন্তত ৫০০ টাকা বেশি দিতে হয়।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সব ধরনের পণ্যবাহী যান রয়েছে তিন লাখ ৮৭ হাজার ৯১৪টি। এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহাম্মেদ মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকার পণ্য পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়নি। ফলে সব সময় গ্রাহকের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ভাড়া ঠিক করতে হয়। আমরা বিআরটিএকে অনেকবার বলেছি গণপরিবহনের মতো পণ্য পরিবহনের ভাড়াও ঠিক করার জন্য। কিন্তু তারা করেনি। ’

হোসেন আহাম্মেদ মজুমদার বলেন, ‘গণপরিবহনের মতো পণ্য পরিবহনের ভাড়াও ব্যয় বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করতে আমরা আবারও বিআরটিএকে প্রস্তাব পাঠাব। আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা প্রতি কিলোমিটার হিসাব করে ভাড়া নিতে চাই। ’

পণ্য পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ভাড়া নির্ধারণের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। তাঁরা বলেছেন, জ্বালানি খরচ, চালক ও সহকারীর বেতন, পথের খরচ, যেমন—পুলিশ ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের চাঁদা এবং পরিবহনের লাভ যোগ করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।

এসব যানের ভাড়া নির্ধারণের উদাহরণ দিতে গিয়ে পণ্য পরিবহন খাতের এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার গাজীপুর থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪৫ কিলোমিটার। পাঁচ টনের একটি ট্রাক এক লিটার তেলে তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার চলে। সেই হিসাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়া-আসায় তেল লাগবে ১৬৩ লিটার। প্রতি লিটার তেল ১১৪ টাকা হিসাবে জ্বালানি খরচ হয় ১৮ হাজার ৬২০ টাকা। প্রতিদিন চালক ও সহকারী মিলিয়ে তিনজনের পেছনে খরচ ৬০০ করে এক হাজার ৮০০ টাকা। তাঁদের বেতন চার হাজার টাকা। পুলিশের চাঁদা দুই হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ২৬ হাজার ৪২০ টাকা খরচ হয়। এর বাইরে মালিকের চার হাজার টাকা লাভ ধরলে ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ার ভাড়া পড়ে ৩০ হাজার টাকা।

অবশ্য বিআরটিএ চাইলেই পণ্য পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই পণ্য পরিবহনের ভাড়া সরকারের ঠিক করে দেওয়া উচিত, না হলে বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তবে বর্তমান সড়ক পরিবহন আইনে পণ্য পরিবহনের ভাড়া সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিআরটিএ ভাড়া নির্ধারণ করতে চাইলে আইন পরিবর্তন করতে হবে। ’

এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিআরটিএর ভাড়া নির্ধারণ কমিটির সদস্য প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস কথা বলতে রাজি হননি। বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

Post a Comment

Previous Post Next Post