ফিটনেসবিহীন এত গাড়ি চলছে কীভাবে?

ফিটনেসবিহীন এত গাড়ি চলছে কীভাবে?


রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের সংখ্যা কত এবং তার মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কত—এর সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই কারও কাছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দাবি, সারা দেশে তাদের নিবন্ধিত বৈধ যানবাহনের সংখ্যা ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৬০টি। এরমধ্যে সাড়ে ৫ লাখের বেশি গাড়ি ফিটনেসবিহীন বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে।


বিআরটিএ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাব বলছে, দেশে নিবন্ধিত যে ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৬০টি যানবাহনের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্তত সাড়ে ৫ লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফিটনেস পরীক্ষা না করায় প্রক্রিয়াটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।


বিআরটিএ’র তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩ লাখ ৩৪ হাজার ২৫২টি যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। সেই হিসাবে গত সাত মাসে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৫৬২টি করে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ির কোনও পরিসংখ্যান নেই সংস্থাটির কাছে।


২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে চট্টগ্রাম-১১ আসনের এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ তথ্য জানান। মালিকদের এসএমএস-এর মাধ্যমে ফিটনেস করার তাগাদা, সার্কেল অফিস থেকে নবায়নের ব্যবস্থার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড ও ডাম্পিংসহ নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে চলাচলের জন্য যেকোনও ভেহিক্যালের যান্ত্রিক ও কাঠামোগত ফিটনেস থাকতে হয়। কাঠামোগত দিকটি চোখে দেখে দেওয়া গেলেও যান্ত্রিক দিক পুরোপুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করার মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত সক্ষমতা এই মুহূর্তে বিআরটিএ’র নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির আন্তরিকতার অভাবের পাশাপাশি লোকবল সংকটও রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ আছে।


একাধিক সূত্রমতে, ৫৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৩৫ লাখের নিবন্ধন থাকলেও বাকি ১৫ লাখের কোনও সনদ নেই। আইন অনুযায়ী নিবন্ধন না থাকা গাড়িগুলোর ফিটনেস সনদও না থাকার কথা। তাছাড়া ফিটনেস সনদ হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নিয়মিত করছে না বাস মালিকরা। বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জমা দেওয়া এক জরিপ প্রতিবেদনে।


আদালতের নির্দেশে গঠিত একটি জাতীয় নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি সে সময় জানায়, ৮৩টি যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেস নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এর ফলাফলে দেখা যায়, ২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট সঠিক নেই অথবা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই ৩৩ শতাংশ বাসের, ৫৬ শতাংশের স্পিড গভর্নর সিল নেই।


বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিআরটিএ অনেকবার জরিমানা ছাড়াই ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করার সুযোগ দিয়েছে। ফিটনেস ছাড়াই সড়কে গাড়ি চলানো গেলে কেন তারা এটি নেবে, এমন একটা ধারণা জন্মেছে মালিকদের মধ্যে। ফলে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চলার চেষ্টা করছে তারা।


বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক হিসাব বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন দায়ী। আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে দুর্ঘটনার জন্য ১১ হাজার ৯২৯টি যানবাহন দায়ী। এরমধ্যে ফিট গাড়ির সংখ্যা ৮ হাজার ১৮টি, আনফিট গাড়ি ২ হাজার ৪৪৫টি এবং অন্যান্য ১ হাজার ৪৬৬টি।


অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের মতে, যানবাহনের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগটা যথাযথভাবে করতে হবে বিআরটিএকে। অন্যথায় আনফিট বা ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনাও বাড়বে। এ জন্য বিআরটিএ-কে অভিযান আরও জোরদার করতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে। মৃত্যুর মিছিল থামাতে এর বিকল্প নেই।


রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলেই বলা হয় গাড়ির ফিটনেস ছিল না। চালকের লাইসেন্স ছিল না। কিন্তু ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে সড়ক পরিবহন আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। একটি অসাধু চক্রের কারণে আইনের এমনটি হচ্ছে, যাতে যত নৈরাজ্য থাকবে, তত চাঁদাবাজি করা যায়। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা ঘটছে, যা প্রাণহানি না বলে হত্যাকাণ্ড বলা উচিত।


বুয়েটের একটি সূত্র বলছে, ইঞ্জিনচালিত ভেহিক্যালের মধ্যে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল রয়েছে ৩৫ লাখের বেশি। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া রয়েছে আরও ১৫ লাখের মতো। ব্যাটারিচালিত যানবাহনের সংখ্যাটা ৪০-৫০ লাখের কাছাকাছি এবং স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি নসিমন-করিমনের মতো গাড়ির সংখ্যাও ১০ লাখের মতো হতে পারে। এসব যানবাহনের মধ্যে বেশিরভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। ফিটনেস সনদ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।


যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, এক লাখ ১০ হাজারের মতো বাস, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা ৪ লাখের কাছাকাছি হবে। পিকআপের সংখ্যা ৭-৮ লাখের মতো। এরমধ্যে ফিটনেসবিহীন বাস ২০ শতাংশ, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ২০-২৫ শতাংশ, পিকআপের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হতে পারে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত হিউম্যান হলারের ৮০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। ৪০ লাখের মতো মোটররিকশাকে আনফিট বলা যায়।


যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চাঁদাবাজি, অনৈতিক অর্থ লেনদেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতার কারণে আনফিট গাড়ি বন্ধ হচ্ছে না। পদে পদে পুলিশের হয়রানিও একটি বড় বাধা। বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা মহলকে ম্যানেজ করে চলেন মালিকরা। ভ্রাম্যমাণ আদালত যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিচালনা না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সড়ক-মহাসড়কে প্রাণহানি ঘটছে।


বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলছেন, ফিটনেস প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে করা না গেলে যানবাহনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে, সেটি দুর্ঘটনা বলা যাবে কিনা তা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। এটির একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে আমলে নেওয়া উচিত।


বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সড়ক-মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধের তারা সারা বছরই তৎপর থাকেন। নিয়মিত অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে পরিবহন মালিকদের কারণেই মূলত ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছে।


অভিযোগ আছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, রুট ভায়োলেশন/রুট পারমিটবিহীন, ফিটনেসবিহীন, হাইড্রোলিক হর্নসহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ে বিআরটিএ অভিযানে নামলেই বেকে বসেন যানবাহন মালিকরা। বিশেষ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামলেই হঠাৎ সড়কে বাস নামানো কমিয়ে দেন তারা। সেই সঙ্গে বিআরটিএ’র অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও নানা অভিযোগ করতে দেখা যায়।


এ বিষয়ে বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কোনও পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। নতুন আইন অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি, বসে নেই।


বিআরটিএ সক্রিয় থাকার পরও সড়কে এত ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। তাদের লোকবলও আছে। তাদের জিজ্ঞাসা করেন কীভাবে এসব গাড়ি সড়কে নামছে। আমরা তো অভিযান চালাচ্ছিই। আর কী করতে পারি?


এ বিষয়ে রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জয়দেব চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। এটি তো আর আমরা দেই না। আমরা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অভিযান চালিয়ে থাকি। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়।

View More



Post a Comment

Previous Post Next Post