নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে আজকের দিনে সড়কে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন চলে টানা ১১ দিন। অন্দোলনের মধ্য দিয়ে আলোর মুখ দেখে সড়ক পরিবহন আইন। আইনটি শতভাগ বাস্তবায়নে বিধিমালাও জারি করেছে সরকার।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির গবেষণার তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল—এই পাঁচ বছরে সারা দেশে ২৮ হাজার ২৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
পাঁচ বছর আগে এই দিনে দুই বাসের পাল্লাপাল্লি গতিতে মারা যান রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও মীম।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি সরকার মেনে নিলেও এর কোনোটি গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে সড়কে প্রতিদিন তাজা প্রাণ ঝরছে।
আইনের মোট ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি ধারায় পরিবর্তন এনে সংশোধিত আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে খসড়া প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদের আইন বিভাগ সংশোধনের সম্মতি দিয়েছে।
বর্তমান আইনের ১০৫ নম্বর ধারায় দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা নিহত হলে দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে আহতদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। আর নিহত ব্যক্তির পরিবারকে পাঁচ লাখের পরিবর্তে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে ভুক্তভোগীকে জরিমানার টাকা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিশোধের জন্য আদালত আদেশ দিতে পারবেন।
সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবে চালকের সহযোগীও শিথিল যোগ্যতায় চালক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এই আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি ধারায় বিদ্যমান কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড কমানো হচ্ছে। আর ভারি ও মাঝারি মোটরযানের সংজ্ঞাসহ আটটি বিষয়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন কয়েকটি ধারাও যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো গৃহীত হলে নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি বা চালকের অবহেলার কারণে দুর্ঘটনায় শুধু আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলে চালককে দায়ী করে বিচার করা যাবে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইন বাস্তবায়নের আগেই সংশোধন হওয়া উচিত না। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনায় ১০ শতাংশ হচ্ছে বিজ্ঞান আর ৯০ শতাংশই রাজনৈতিক। তাই আমাদের সড়কের রোগটাও রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব না। গত পাঁচ বছরে সড়ক-মহাসড়কের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আমরা অনেক নতুন ও আধুনিক সড়ক পেয়েছি। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ সুবিধাও পাচ্ছে। কিন্তু সড়কে লাশের মিছিল থামছে না।’
হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সড়কের উন্নয়ন করে কোনো লাভই হবে না, যদি না সমানতালে পরিবহন ও চালকের উন্নয়ন করা না যায়। সড়কে যত ধরনের বিশৃঙ্খলা আছে সেসব রেখেই আমরা যখন সড়ককে মোটাতাজা করছি, অর্থাৎ ঝুঁকি রেখেই গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছি, তখনই এগুলো দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ হয়ে যাচ্ছে। চালক, পরিবহন ও এনফোর্সমেন্ট কিছুই ভালো না। এনফোর্সমেন্ট তখনই ঠিক রাখা যায়, যখন পাঁচজন নিয়ম ভঙ্গ করে; ৯০ জন নিয়ম ভাঙলে এনফোর্সমেন্ট প্রয়োগ করা যায় না।’
সড়কের আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যে দাবিগুলো তুলে ধরেছিল তার মধ্যে ঢাকার বাসে অর্ধেক ভাড়া বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে সারা দেশে অর্ধেক ভাড়া কার্যকর হয়নি। শিক্ষার্থীরা বলেছিল, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না এবং বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না। সেই আন্দোলনের সময় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) নামের একটি সংগঠন গঠিত হয়। সেই সংগঠন দফায় দফায় নানা কর্মসূচি পালন করছে। নিরাপদ সড়কের দাবি এখনো কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না জানতে চাইলে সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম আপন বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমাদের সব দাবি প্রধানমন্ত্রী মেনে নিলেও সেগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু দিন দিন বাড়ছে। আমাদের আন্দোলনের মুখে যে আইন পাস করা হয়েছিল সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। শতভাগ বাস্তবায়নের আগেই সংশোধন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’
শহীদুল ইসলাম জানান, আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট তাঁদের ওপর হামলা করা হয়েছিল। তাই ওই দিন তাঁরা মানববন্ধন ও আলোচনাসভাসহ বেশ কিছু কর্মসূচির আয়োজন করবেন।
Post a Comment