কঠোর নীতিমালা করে সড়কে গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে


কঠোর নীতিমালা করে সড়কে গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে

সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজিব ঘোষ


কঠোর নীতিমালা করে সড়কে গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে

মো. হাদিউজ্জামান


কালের কণ্ঠ : কয়েক বছরের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। দুর্ঘটনা কেন নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না?


হাদিউজ্জামান : দুর্ঘটনা কমানোর জন্য যে উদ্যোগগুলো আমরা দেখি তাতে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে এটা ঠিক। সব উদ্যোগের অর্জন একেবারেই শূন্য সেটা আমি বলব না। তবে আহত ও মৃত্যুর সংখ্যা না কমার পেছনে কারণ হচ্ছে, পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা দূর হয়নি।



আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা অবহেলা, অসন্তোষ আছে। গত কয়েক বছরে আমরা সড়ক-মহাসড়কের একটা বড় নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। সড়ককে প্রসারিত করেছি, দুই লেন থেকে চার লেন করেছি। সড়ক বিভাজক দিয়েছি, সার্ভিস লেন করেছি।


দুর্ঘটনা কমাতে নিরাপদ অবকাঠামো তৈরির জন্য আমরা যেমন চেষ্টা করছি, সেভাবে চালকদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারছি না। এখানেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাটা ফসকে যাচ্ছে।

কালের কণ্ঠ : বড় সড়ক অবকাঠামোতে দুর্ঘটনা মানে বড় দুর্ঘটনা এবং বেশি মৃত্যু। সম্প্রতি ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।


এই বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?

হাদিউজ্জামান : এটা আসলে অবকাঠামোর দোষ নয়। আমরা কিন্তু সার্ভিস লেন দিয়ে ধীরগতির যানবাহনকে আলাদা করে দিচ্ছি। সমস্যাটা হলো, আমরা দ্রুতগতির সড়ক তৈরি করছি। অর্থাৎ গতিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। কিন্তু দ্রুতগতিতে চলার জন্য যে ধরনের যানবাহন দরকার, যে ফিটনেসের দরকার, সেখানে আমরা কাজ করছি না।


বরং আমরা দেখছি প্রতিবছর আনফিট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে বড় সংখ্যাই হচ্ছে ভারী যানবাহনের। দ্বিতীয়ত, দ্রুতগতিতে যান চালানোর জন্য যে ধরনের চালক দরকার, চালকদের যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দরকার, সেগুলো আমরা দিতে পারছি না।

কালের কণ্ঠ : সড়কে ৪০ শতাংশ বাস আনফিট বা চলাচলের অযোগ্য। সম্প্রতি বিআরটিএর চেয়ারম্যানও জানিয়েছেন, পাঁচ লাখের বেশি গাড়ি আনফিট। সড়ক থেকে আনফিট গাড়ি কেন সরানো যাচ্ছে না? দুর্ঘটনার জন্য এসব গাড়ি কতটা দায়ী বলে আপনি মনে করেন?


হাদিউজ্জামান : আনফিট গাড়ির যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে, এটা মূলত কাগজের পরিসংখ্যান। কিন্তু আমি বলব, কাগজে যেগুলো ফিট আছে তাদের মধ্যেও একটা অংশ বাস্তবে আনফিট। কারণ আমাদের ফিটনেস নির্ণয় পদ্ধতিতে গলদ আছে। চোখে দেখে গাড়িকে ফিট, আনফিট ঘোষণা করা হয়। আনফিট যানবাহন মানেই হচ্ছে সেখানে যান্ত্রিক ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। সড়কের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বড় যানগুলো আনফিট থাকলে তাদের ব্রেকিং সিস্টেম দুর্বল থাকে। এতে করে এ ধরনের যানবাহনে সড়কে দুর্ঘটনা বেশি হয়। আবার আনফিট গাড়ির জন্য ফিট গাড়িও সড়কে হুমকির মুখে পড়ে।


কালের কণ্ঠ : ঢাকা শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রায় ৬০ শতাংশ হচ্ছে পথচারী। সারা দেশেও মোট মৃত্যু প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ পথচারী। আমাদের সড়কগুলো কেন পথচারীবান্ধব হচ্ছে না?


হাদিউজ্জামান : আমাদের বড় সড়কগুলো পথচারীবান্ধব হচ্ছে কি না তা সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ যে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করলাম, অত্যন্ত দুঃখজনক যে সেখানে র‌্যাম্প নামাতে গিয়ে ঢাকা শহরে ফুটপাত আরো কমিয়ে ফেলেছি। অথচ সড়কের সঙ্গে পথচারীর একটা সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে। কোনোভাবেই সেই সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। সড়ককে পথচারীবান্ধব করতেই হবে। পথচারীর জায়গা রেখে সড়ক তৈরি করা দরকার। আমরা যে সড়ক-মহাসড়ক তৈরি করছি এর দুই পাশে যারা থাকে, তাদের সামাজিক বন্ধন আমরা নষ্ট করতে পারি না। তারা সড়কের এই পাশ থেকে ওই পাশে যাতায়াত করবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে তাদের বিবেচনায় রেখেই অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। না হলে এই মৃত্যু কমানো যাবে না।


কালের কণ্ঠ : কয়েক বছর ধরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও। এর রাশ টানা যায় কিভাবে?


হাদিউজ্জামান : আমরা আসলে কারো কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যারা ব্যাপকভাবে ভুগেছে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু শিখিনি, শিখতে চাইনি। মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনা বাড়বে, এটা পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং চীন, ভিয়েতনামেও অনেক আগেই প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু আমরা মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী কম্পানি যেসব দেশে অবস্থান করছে সেখানেও অন্তত ২৫ লাখ মোটরসাইকেল সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমরা মোটরসাইকেলকে অবাধে সড়কে নামতে দিয়েছি। আবার তাদের প্রশিক্ষণ আছে কি না, লাইসেন্স আছে কি না, সেদিকে আমরা নজর দিচ্ছি না। আমাদের সড়ক মোটরসাইকেলবান্ধব কি না সেটা আমরা বিবেচনা করছি না। নীতিগত পরিবর্তনে এখন ভূমিকা রাখা না গেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সামনে আরো বাড়বে।


কালের কণ্ঠ : শেষ প্রশ্ন, সড়কে মানুষকে রক্ষার জন্য কী করণীয়?


হাদিউজ্জামান : দুর্ঘটনার সমাধানকে আসলে স্বল্পকালীন প্রকল্প হিসেবে দেখলে হবে না। এটার জন্য সারা বছর ৩৬৫ দিনই দরদ দিয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের গণপরিবহনের যে ব্যবস্থা আছে তাকে কিভাবে শৃঙ্খলে আনা যায়, সেটা দেখতে হবে। পাশাপাশি ফুটপাতগুলোকে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে এবং ফুটপাতগুলোকে পথচারীবান্ধব ও নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে, যাতে করে পথচারীরা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে না আসে। সড়কে সক্ষমতার বাইরে যানবাহনের সংখ্যা চলে গেছে। এর জন্যই মূলত সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা কাজ করছে। কঠের নীতিমালার মধ্য দিয়ে যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গণপরিবহনভিত্তিক যে উন্নয়নের দর্শনের কথা আমরা বলি, সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে।


কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।


হাদিউজ্জামান : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে নিরাপদ সড়ক দিবসে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহবান জানাচ্ছি।

Post a Comment

Previous Post Next Post